বেপরোয়া চালকরা বিকারহীন, দুষলেন মালিকের ‘টার্গেটকে’ | bdevent24




যাদের জমা নির্দিষ্ট করা নেই তাদের কেউ বেশি ভাড়া উঠিয়ে নিজের ভাগের অংক বড় করা, আবার কেউ মালিককে সন্তুষ্ট করতে রাস্তায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
তাদের ভাষ্য মতে, ঢাকার বেশিরভাগ রুটের বাসের জমার টাকা মালিকরা নির্ধারণ করে দেন। আবার কিছু পরিবহন তাদের আয় হিসেব করে মোট যাত্রী পরিবহনের উপর (পথে চেকারদের দেওয়া হিসাব-ওয়ে বিল)। সেখানেও যাত্রী বেশি তোলার জন্য মালিকপক্ষের চাপ থাকে।
প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে এক বাসের সঙ্গে আরেক বাসের ঠোকাঠুকি, সংঘর্ষ নিত্যদিনের ঘটনা। এ কারণে বেশিরভাগ পরিবহনের বাসের গায়ের রং চটে গেছে। খুলে গেছে বাম্পার, সংকেত বাতি। প্রায়ই ভাঙছে ভিউ মিরর।
অন্যদিকে মালিকরা দুষছেন চালকদের। তারা বলছেন, ভালো চালকের যেমন অভাব রয়েছে, পাশাপাশি চালকদের মাদকাসক্তিও দুর্ঘটনার কারণ।
এই মাসের প্রথম দিকে কারওয়ানবাজারে দুই বাসের পাল্লার মধ্যে পড়ে বাম হাত হারান তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার রাতে মারা যান তিনি।
এভাবে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রাজীবের মৃত্যু তুমুল আলোচনার জন্ম দিলেও তার কোনো প্রভাব নেই চালকদের মধ্যে।
মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে রামপুরায় প্রগতি সরণিতে আড়াআড়ি করে বাস রেখে যাত্রী তুলছিলেন অনাবিল পরিবহনের এক চালক। এ বাসের গায়ের রং চটে গেছে। বাম্পার খুলে গেছে অনেক জায়গায়। হেডলাইট ছাড়া সামনে পেছনে আর একটি বাতিও নেই।
জানতে চাইলে চালক শিপন বলেন, অন্য বাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে গাড়ির এই হাল হয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় ডানপাশের জানালা দিয়ে বারবার পেছনে তাকাচ্ছিলেন শিপন।
“পিছনের গাড়ি আগে গেলে ‘গ্যাপ খাইয়া’ ফালাইব,” চোখেমুখে তাড়াহুড়া নিয়ে বলছিলেন তিনি।
বাসের এ অবস্থার জন্য মালিক কিছু বলে কি না- জানতে চাইলে শিপন বলেন, “হের দরকার টাকা। আর গাড়ি কি রাস্তায় সাজাইয়া রাখনের লাইগা আনছে? একটু হইবোই।”
তিনি দাবি করেন, যাত্রীদের যেন কোনো সমস্যা না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেই অন্য বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেন তারা।
সকালে কুড়িল এলাকায় পাল্লা দিয়ে চালানোর অপরাধে সদরঘাট-গাজীপুর রুটের সুপ্রভাত পরিবহনের দুটি বাস আটকে ২২০০ টাকা করে জরিমানা করে ট্রাফিক পুলিশ।
একটি বাসের চালক রাব্বী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাস্তায় গাড়ি চললে এরম পারাপারি (পাল্লা দেওয়া) হইবোই।”
মালিকের জমা ও রাস্তার খরচ উঠিয়ে নিজেদের ভাগেরটা পান জানিয়ে তিনি বলেন, “মালিকের টার্গেট তিন হাজার ৮০০ টাকা। তেল লাগে চার হাজার টাকা। এরপর রাস্তার চান্দা, খাওয়া-দাওয়া মিল্লা আরও ১৫০০ টাকা। এরপর যা আহে তা দিয়া নিজেগো বেতন।”
বেলা ১২টার দিকে বিমানবন্দর সড়কের কুড়িল বিশ্বরোড বাসস্ট্যান্ডে প্রজাপতি পরিবহনের বাসের পেছনের বাম্পারে ধাক্কা দিচ্ছিল তেঁতুলিয়া পরিবহনের বাস। এক পর্যায়ে বাসটি প্রজাপতির বাসের বাঁ দিকে ঢুকিয়ে দিয়ে আগে যেতে চায়। সেখানে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা অনেকটা পেছনে সরে আসেন।
এভাবে প্রতিযোগিতার কারণ জানতে চাইলে তেঁতুলিয়া পরিবহনের বাসের চালকের সহকারী নুরুন্নবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে গেলে যাত্রী বেশি পাওয়া যায়। আমদানি বেশি দেখানো যায়। মালিকরা বোনাস-টোনাস দেয়। আমারও কিছু ইনকাম হয়।”
চালকদের এ অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্য প্রায়ই বিপদে পড়তে হয় বলে জানান ফার্মগেইট যাওয়ার জন্য সেখানে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা আলমাস আলী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এরা প্রায় সব সময়ই এমন করে। মনে হয় গায়ের ওপর উঠিয়ে দেবে। বাস থেকে নামার সময়ও দেখা যায়, পাশ থেকে আরেক গাড়ি চেপে ধরে। এদের কারণে প্রায়ই বিপদের মুখে পড়তে হয়।”

দুপুরে মিরপুর ‌১০ নম্বর গোলচত্বরে দেখা যায়, কোনো বাসের চালক অন্য বাসকে আগে যেতে দিতে চাইছেন না। সড়কজুড়ে দুই-তিন সারি করে বাস দাঁড় করিয়ে রেখেছেন তারা। কোনো বাস পেছন থেকে, কোনোটি বাঁ পাশ থেকে সামনে থাকা বাসকে ধাক্কা দিচ্ছে।
এসব বাসের মধ্যে আজিমপুর থেকে মিরপুর রুটের মিরপুর লিঙ্ক পরিবহনের বাসও ছিল। তার একটির চালক নাসির উদ্দিন বলেন, মালিকের ‘ইনকাম’ বাড়ানোর আশায় নিজেদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা করেন তারা।
“আমাগো এই লাইনে কোনো পরিবহনেরই টার্গেট দেওয়া নাই। কিন্তু একই কোম্পানিতে বিভিন্ন মালিকের গাড়ি চলে। আমদানি কম হইলে মালিক কয়, ‘হের আমদানি বেশি, তোর কম ক্যান?’ ইনকাম বাড়ানের লাইগা অন্য বাসের লগে পাল্টাপাল্টি করতে হয়।” 
প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে বাসের ক্ষতি হওয়ার কথা স্বীকার করেন গাবতলী-রামপুরা রুটের আলিফ পরিবহনের বাসের চালক মোহাম্মদ মিজান।
“এই রুটে গাড়ি চালাই কমিশন হিসাবে। এক হাজার টাকায় আমি ১১০ টাকা পাই। হেল্পার পায় ৭০ টাকা। এখন আমরা কী করুম? এ্যামনে গাড়ি চালাইলে অন্য গাড়ির লগে ধাক্কাধাক্কি করা লাগে। গাড়ির রং উইঠা যায়। লুকিং গ্লাস ভাঙ্গে প্রায় প্রত্যেকদিন।”
মালিকরা ‘টার্গেট’ পদ্ধতি উঠিয়ে দিলে প্রতিযোগিতা এমনিতেই কমে যাবে বলে মনে করেন দেওয়ান পরিবহনের চালক আবদুস সালাম।
তিনি বলেন, “আমি চাইর মাস রাইদা পরিবহনের গাড়ি চালাইছি। ওই খানে কোনো টার্গেট আছিল না। তিন মাসে গাড়িতে একটা আঁচড়ও লাগে নাই।”
চালকদের এ অভিযোগ সব ক্ষেত্রে ঠিক নয় বলে দাবি করেন তেঁতুলিয়া পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ মাসুম। তিনি দোষ দিচ্ছেন চালকদেরই।
ওয়াদুদ বলেন, “আমাদের একটা টার্গেট থাকে, ঠিক আছে। কিন্তু প্রতিযোগিতা করে ইনকাম করা এক জিনিস, আর প্রতিযোগিতা করে মানুষ মারা, অন্য গাড়িকে ধাক্কা দেওয়া সেটা আরেক জিনিস। তারা যদি দুই থেকে তিন মিনিট গ্যাপে যায় তাহলে যাত্রী এমনিতেই পাবে। কিন্তু তারা আগে যেতে চায় বলেই সমস্যাগুলো তৈরি হয়। এই প্রতিযোগিতা করে তো আমাদের ট্রিপ বেশি দিতে পারছে না।”
দক্ষ চালকের অভাবে এই সমস্যা হচ্ছে বলে মনে করেন এই বাস মালিক।
“বছরে একটা গাড়ি চারবার মেরামত করতে হয়। মূল সমস্যা হচ্ছে, এখন আর ভালো ড্রাইভার তৈরি হচ্ছে না। ভালো ড্রাইভার হলে এ ধরনের সমস্যা অনেকটা কমে যেত।”

গন্তব্যে যেতে চলন্ত বাসে ঝুঁকি নিয়ে উঠছেন যাত্রীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
বেপরোয়া বাস চালানোর জন্য চালকদের ‘মাদকাসক্তিকে’ দায়ী করেন প্রচেষ্টা পরিবহনের মালিক মেহেদী হাসান বেলাল।
ঢাকায় গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত সপ্তাহে মালিক-শ্রমিকদের এক বৈঠকে তিনি বলেন, “চালকরা মাদক ও নেশায় নিমজ্জিত। তাদের এই বিষয়ে বোঝাতে হবে। জীবন, সংসার ও সঞ্চয়ের প্রতি তাদের আগ্রহী করতে হবে।”
কলেজছাত্র রাজীবের মৃত্যু নগরের গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলার ফল বলে মন্তব্য করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দিন।
“আমি তো মনে করি তাই। ছেলেটা মারা গেল দুটি বাসের প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে।”
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সাবেক এই নির্বাহী পরিচালকের মতে, রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে রুট পুনর্বিন্যাসের বিকল্প নাই।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন ২৪২টা রুটে বাস চালাচ্ছে মালিকরা। নতুন পদ্ধতি চালু হলে রুটের সংখ্যা হবে ছয়টি। এটা হলে পরিবহনগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা কমে যাবে। সব প্যাসেঞ্জারই সব বাসে চড়তে পারবে। অপারেটররা যাত্রী এখন যেমন নিচ্ছে তেমনই নেবে, কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে কম্পিটিশনে যাবে না।”

SHARE THIS

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 comments: